সূরা আছর দারসুল
بِسْمِ
اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম
করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)
* وَالْعَصْر * إِنَّالْإِنْسَانَ
لَفِي خُسْر* إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا
بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا
بِالصَّبْرِ
অনুবাদ: ১) কালের শপথ!(২) নিশ্চয়ই সকল
মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে।(৩) তারা ব্যতীত যারা (জেনে-বুঝে) ঈমান এনেছে
ও সৎকর্ম সম্পাদন করেছে এবং পরস্পরকে ‘হক’-এর উপদেশ দিয়েছে ও পরস্পরকে ধৈর্য্যের উপদেশ
দিয়েছে।
বিষয়বস্ত্ত :
সূরা আসর এর নামকরণ
প্রথম আয়াতে “আল-আসর” থেকে এই সূরাটির নামকরণ করা হয়েছে।]
সূরা আসর নাযিল হবার সময়কাল
মুফাসসিরগণের
অধিকাংশের মতে এই সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। আর এই সূরা সাক্ষ্য দেয়, এটি মাক্কী যুগের প্রথমে অবতীর্ণ
হয়েছে।
সূরা শারহ-এর পরে মক্কায় অবতীর্ণ।সূরা
নং ১০৩, আয়াত ৩, শব্দ ১৪, বর্ণ ৭০।কালের শপথ করে বলা হয়েছে যে, সকল
মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে, চারটি গুণবিশিষ্ট মানুষ ব্যতীত (১-৩ আয়াত)। যা হ’ল, ঈমান, আমল, দাওয়াত ও
ছবর।এই
সূরাতে মানুষের সফলতা, কল্যাণ ও
ধ্বংস সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
তাফসীর :
(১) وَالْعَصْرِ ‘কালের শপথ’।
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, العصر أى الدهر ‘আছর’ অর্থ ‘কাল’ (কুরতুবী)। ওয়াও (واو) হ’ল শপথের অব্যয়। অর্থাৎ কালের
শপথ। যার মধ্যে আদম সন্তানের ভাল-মন্দ সকল কাজ সম্পাদিত হয় (ইবনু কাছীর)। তাছাড়া কালের মধ্যে বিস্ময়কর
ঘটনা সমূহ ঘটার কারণে একে ‘বিস্ময়ের কেন্দ্র’ (ابو العجب) বলা হয় (ক্বাসেমী)।
কালের শপথ আল্লাহ সম্ভবতঃ এজন্য করেছেন যে, বান্দা ভাল-মন্দ যে কাজই করুক
না কেন তা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এই তিনকালের মধ্যেই তাকে করতে হয়। এর বাইরে গিয়ে
সে কিছুই করতে পারে না। অতএব তাকে সবসময় আল্লাহর দৃষ্টির সামনেই থাকতে হয়। কেননা
বান্দার হিসাবে কাল তিনটি হ’লেও আল্লাহর নিকটে সবই বর্তমান কাল।
খ্যাতনামা মুফাসসির ইমাম রাযী (৫৪৪-৬০৬ হি:) আছর-এর সঠিক তাৎপর্য কি হবে, সেবিষয়ে জনৈক বিগত মনীষীর (بعض السلف) উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, তিনি এটা নিয়ে
গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। এমতাবস্থায় জনৈক বরফ বিক্রেতার আওয়ায তাঁর কানে এল। সে চিৎকার
দিয়ে ক্রেতাদের উদ্দেশ্যে বলছে, اِرْحَمُوْا مَنْ يَّذُوْبُ رَأْسُ مَالِهِ ‘তোমরা রহম কর ঐ ব্যক্তির প্রতি, যার পুঁজি প্রতি মুহূর্তে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে’। একথা শুনেই তিনি বলে উঠলেন, هَذَا مَعْنَى سُوْرَةِ
الْعَصْرِ… ‘এটাই তো সূরা
আছরের তাৎপর্য। যার বয়স চলে যাচ্ছে। অথচ কোন সৎকর্ম করছে না। সে অবশ্যই
ক্ষতিগ্রস্ত’ (তাফসীর রাযী)। বস্ত্ততঃ ‘কাল’ প্রতি সেকেন্ডে সময়ের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। অতএব
প্রত্যেক মানুষকে তার সংক্ষিপ্ত আয়ুষ্কালের মধ্যেই ক্ষতির হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা
করতে হবে। কেননা সে প্রতি সেকেন্ডে ১ লক্ষ ৮৬ হাযার মাইল (৩ লক্ষ কি: মি:) গতিবেগে
তার মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে। বরফ গলার ন্যায় প্রতি সেকেন্ডে তার আয়ু শেষ হয়ে
যাচ্ছে। সাথে সাথে কালের স্মৃতিপটে তার প্রতিটি কথা ও কর্ম লিপিবদ্ধ হচ্ছে। এ
কারণেই আল্লাহ কালের শপথ করেছেন।
(২) إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِيْ
خُسْرٍ ‘নিশ্চয়ই সকল
মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে’।
অর্থাৎ পরিণতিতে তারা ক্ষতির মধ্যে আছে। যেমন
আল্লাহ অন্যত্র বলেন, فَذَاقَتْ وَبَالَ أَمْرِهَا وَكَانَ عَاقِبَةُ أَمْرِهَا خُسْرًا ‘অতঃপর তারা
তাদের কৃতকর্মের আযাব আস্বাদন করল। বস্ত্ততঃ ক্ষতিই ছিল তাদের কর্মের পরিণতি’ (তালাক ৬৫/৯)। এটি হ’ল পূর্ববর্তী শপথের জওয়াব।
এখানে إِنَّ الْإِنْسَانَ لَخَاسِرٌ (নিশ্চয়ই সকল মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত) না
বলে لَفِيْ خُسْرٍ (অবশ্যই ক্ষতির
মধ্যে রয়েছে) বলার মাধ্যমে একথা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, إن الانسان منغمس فى الخسر من كل
جانب ‘নিশ্চয়ই মানুষ
চারদিক থেকে ক্ষতির মধ্যে ডুবে আছে’। فِيْ এখানে ظرفية হয়েছে।
এখানে إِنَّ الْإِنْسَانَ لَخَاسِرٌ (নিশ্চয়ই সকল মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত) না বলে لَفِيْ خُسْرٍ (অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে)
বলার মাধ্যমে একথা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, إن الانسان منغمس فى الخسر من كل جانب ‘নিশ্চয়ই মানুষ চারদিক থেকে ক্ষতির মধ্যে ডুবে আছে’। فِيْ এখানে ظرفية হয়েছে।
الْإِنْسَانَ -এর اَلْ অর্থ كُلٌّ ‘সকল মানুষ’। اَلْ দ্বারা جنس বা জাতি বুঝানো হয়েছে। এর
মাধ্যমে মানুষের স্বভাবগত ক্ষতিপ্রবণতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। অতঃপর মানুষ যে
ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় প্রতিনিয়ত ক্ষতির মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে, সে কথাটা জোরালোভাবে ব্যক্ত
করার জন্য সূরার শুরুতে وَالْعَصْرِ -এর واو দ্বারা শপথ, অতঃপর অত্র বাক্যের শুরুতে إِنَّ এবং শেষে لَ (لَفِيْ خُسْرٍ )
সহ মোট
তিনিট নিশ্চয়তাবোধক অব্যয় আনা হয়েছে। বিগত যুগের বিধ্বস্ত সভ্যতাসমূহ এবং বর্তমান
যুগের ধর্মনিরেপক্ষ বস্ত্তবাদী সভ্যতাসমূহ যা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে নিজেদেরকে
ধ্বংসের দিকে নিয়ে চলেছে, এগুলি হ’ল আল্লাহর উপরোক্ত সাবধানবাণীর বাস্তব প্রমাণ।
(৩) إِلاَّ الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا
بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ ‘তারা ব্যতীত, যারা ঈমান এনছে ও সৎকর্ম
সম্পাদন করেছে এবং পরস্পরকে ‘হক’-এর উপদেশ দিয়েছে ও পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে’।
অর্থাৎ ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচতে পারে কেবল চারটি গুণবিশিষ্ট
মানুষ। যার মধ্যে প্রথম দু’টি হ’ল ব্যক্তিগত ও পরের দু’টি হ’ল সমাজগত। প্রথম দু’টির প্রথমটি হ’ল ঈমান এবং দ্বিতীয়টি হ’ল আমল। এর দ্বারা মানুষের মধ্যে
লুক্কায়িত জ্ঞানশক্তি ও কর্মশক্তির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। জ্ঞান যদি তাওহীদ
বিশ্বাসের উপর ভিত্তিশীল হয়, তবে তার কর্ম হবে মঙ্গলময়। আর যদি তা না হয়, তবে তার কর্ম হবে অকল্যাণময়।
মানুষের বাস্তব ও ব্যবহারিক জীবনে এদু’য়ের ফলাফল সুস্পষ্ট। যে জাতি
ইলমী ও আমলী শক্তিতে উন্নত, সে জাতিই পৃথিবীতে উন্নত হয়। মুসলমানদের প্রাথমিক যুগের ইতিহাস তার
বাস্তব সাক্ষী। অতএব ক্ষতি থেকে বাঁচতে হ’লে মানুষকে নিম্নোক্ত চারটি গুণ
অর্জন করতে হবে-
(১) ঈমান (الإيمان بالله) : পৃথিবীতে মানুষে মানুষে
পার্থক্যের মানদন্ড হ’ল ঈমান। যারা আল্লাহতে বিশ্বাসী, তারা ইহকাল ও পরকালে সফলকাম।
পক্ষান্তরে যারা আল্লাহতে অবিশ্বাসী, তারা ইহকাল ও পরকালে ব্যর্থকাম।
ঈমানদারের সকল কাজ হয় আখেরাতমুখী। পক্ষান্তরে অবিশ্বাসীদের সকল কাজ হয়
প্রবৃত্তিমুখী। দু’জনের জীবনধারা হয় সম্পূর্ণ পৃথক। আল্লাহ বলেন, وَمَا
نُرْسِلُ الْمُرْسَلِينَ إِلاَّ مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ فَمَنْ آمَنَ
وَأَصْلَحَ فَلاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُونَ – وَالَّذِينَ
كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا يَمَسُّهُمُ الْعَذَابُ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ ‘আমরা রাসূলদের পাঠিয়ে থাকি
এজন্য যে, তারা মানুষকে জান্নাতের সুসংবাদ দিবে ও জাহান্নামের ভয় প্রদর্শন
করবে। এক্ষণে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও নিজেকে সংশোধন করে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা
কোনরূপ চিন্তান্বিত হবে না’। ‘পক্ষান্তরে যারা আমাদের আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করে, তাদের পাপাচারের কারণে তাদেরউপর শাস্তি আপতিত হবে’ (আন‘আম ৬/৪৮-৪৯)।
الإيمان
من الأمن ضد الخوف والشك ঈমান অর্থ নিশ্চিন্ত বিশ্বাস, যা ভীতি ও সন্দেহের বিপরীত।
সন্তান যেমন পিতা-মাতার কোলে নিশ্চিন্ত হয়, মুমিন তেমনি আল্লাহর উপরে ভরসা
করে নিশ্চিন্ত হয়।
মুমিনের
বিশ্বাসের ভিত্তি হ’ল ছয়টি : أَنْ تُؤْمِنَ بِاللهِ
وَمَلاَئِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَتُؤْمِنَ
بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ (১) আল্লাহর উপরে বিশ্বাস, (২) তাঁর ফেরেশতাগণের উপর
বিশ্বাস, (৩) তাঁর প্রেরিত কিতাব সমূহের উপর বিশ্বাস, (৪) তাঁর প্রেরিত রাসূলগণের উপর বিশ্বাস, (৫) বিচার দিবসের উপর বিশ্বাস
এবং (৬) আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত তাক্বদীরের ভাল-মন্দের উপর বিশ্বাস। যা হাদীছে
জিব্রীলে বর্ণিত হয়েছে।[9] যাকে ঈমানে মুফাছছাল বলা হয়।
অতঃপর মুমিনের বিশ্বাসের সারকথা বা ঈমানে মুজমাল হ’ল, آمَنْتُ بِاللهِ
كَمَا هُوَ بِأَسْمَائِهِ وَصِفَاتِهِ وَقَبِلْتُ جَمِيْعَ أَحْكَامِهِ
وَأَرْكَانِهِ আমি বিশ্বাস স্থাপন করলাম
আল্লাহর উপরে যেমন তিনি, তাঁর যাবতীয় নাম ও গুণাবলী সহকারে এবং আমি কবুল করলাম তাঁর যাবতীয়
আদেশ-নিষেধ ও ফরয-ওয়াজিব সমূহকে’। অতঃপর ঈমানের সংজ্ঞা হ’ল,اَلتَّصْدِيْقُ
بِالْجِنَانِ وَالْإِقْرَارُ بِالْلِسَانِ وَالْعَمَلُ بِالْأَرْكَانِ يَزِيْدُ
بِالطَّاعَةِ وَيَنْقُصُ بِالْمَعْصِيَةِ، اَلْإِيْمَانُ هُوَ الْاَصْلُ
وَالْعَمَلُ هُوَ الْفَرْعُ- ‘হৃদয়ে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি ও কর্মে
বাস্তবায়নের নাম হ’ল ঈমান, যা আনুগত্যে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং গোনাহে হরাসপ্রাপ্ত হয়। ঈমান হ’ল মূল এবং আমল হ’ল শাখা’। যা না থাকলে পূর্ণ মুমিন বা
ইনসানে কামেল হওয়া যায় না। অতএব জনগণের ঈমান যাতে সর্বদা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, পরিবার, সমাজ ও সরকারকে সর্বদা সেই
পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। নইলে ঈমান হরাসপ্রাপ্ত হ’লে সমাজ অকল্যাণে ভরে যাবে।
(২) সৎকর্ম (العمل
الصالح) : আল্লাহ বলেন, أَمَّا الَّذِينَ آمَنُوا
وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فَلَهُمْ جَنَّاتُ الْمَأْوَى نُزُلاً بِمَا كَانُوا
يَعْمَلُونَ ‘আর যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের কৃতকর্মের পুরস্কার স্বরূপ তাদের আপ্যায়নের
জন্য জান্নাত হবে তাদের বাসস্থান’ (সাজদাহ ৩২/১৯)। তিনি বলেন,إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا
وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَئِكَ هُمْ خَيْرُ الْبَرِيَّةِ، جَزَاؤُهُمْ عِنْدَ
رَبِّهِمْ جَنَّاتُ عَدْنٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا
أَبَدًا رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ ذَلِكَ لِمَنْ خَشِيَ رَبَّهُ ‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তারাই হ’ল সৃষ্টির
সেরা’। ‘তাদের জন্য
প্রতিদান রয়েছে তাদের প্রতিপালকের নিকটে চিরস্থায়ী বসবাসের বাগিচাসমূহ; যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হয় নদী সমূহ। যেখানে
তারা অনন্তকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁর উপরে সন্তুষ্ট।
এটা তার জন্য, যে তার পালনকর্তাকে ভয় করে’ (বাইয়েনাহ
৯৮/৭-৮)।
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন,
كَيْفَ أَنْتُمْ إِذَا
لَبِسَتْكُمْ فِتْنَةٌ يَهْرَمُ فِيهَا الْكَبِيرُ وَيَرْبُو فِيهَا الصَّغِيرُ ، يَجْرِي
عَلَيْهَا النَّاسُ يَتَّخِذُونَهَا سُنَّةً ، قَالُوا : وَمَتَى ذَاكَ؟ قَالَ :
إِذَا ذَهَبَتْ عُلَمَاؤُكُمْ وَكَثُرَتْ جُهَلاَؤُكُمْ ، وَكَثُرَتْ قُرَّاؤُكُمْ
وَقَلَّتْ فُقَهَاؤُكُمْ ، وَكَثُرَتْ أُمَرَاؤُكُمْ وَقَلَّتْ أُمَنَاؤُكُمْ ،
وَالْتُمِسَتِ الدُّنْيَا بِعَمَلِ الآخِرَةِ وَتُفُقِّهَ لِغَيْرِ الدِّينِ–
‘তোমাদের অবস্থা তখন কেমন হবে
যখন ফিৎনা (বিদ‘আত) তোমাদেরকে এমনভাবে ঘিরে নিবে যে, এই ফিৎনার মধ্যেই তোমাদের বড়রা
বৃদ্ধ হবে এবং ছোটরা বড় হবে। মানুষ বিদ‘আতের উপরেই চলতে থাকবে।
এমতাবস্থায় তারা সেটাকেই ‘সুন্নাত’ হিসাবে গ্রহণ করবে। লোকেরা বলল, এটা কখন হবে? তিনি বললেন, (ক) যখন তোমাদের আলেমগণ
মৃত্যুবরণ করবেন ও মূর্খদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। (খ) যখন সাধারণ আলেমের সংখ্যা
বৃদ্ধি পাবে, কিন্তু জ্ঞানী আলেমের সংখ্যা কমে যাবে। (গ) যখন নেতার সংখ্যা
বৃদ্ধি পাবে, কিন্তু আমানতদারের সংখ্যা কমে যাবে। (ঘ) যখন আখেরাতের কাজের
মাধ্যমে মানুষ দুনিয়া তালাশ করবে এবং দ্বীন ব্যতীত অন্য উদ্দেশ্যে জ্ঞানার্জন করবে’।
আল্লাহ বলেন, قُلْ
هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالاً- الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي
الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا ‘তুমি বলে দাও, আমরা কি তোমাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত
আমলকারীদের সম্পর্কে খবর দিব?’ ‘পার্থিব জীবনে যাদের সকল
প্রচেষ্টা বরবাদ হয়েছে। অথচ তারা ধারণা করেছে যে, তারা সৎকর্ম করেছে’ (কাহফ ১৮/১০৩-১০৪)।
(৩) দাওয়াত (الدعوة
الى الله) : আয়াতে বর্ণিত দু’টি সমাজগত গুণের প্রথমটি হ’ল ‘পরস্পরকে
হক-এর উপদেশ দেওয়া’ (وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ)। এটি হ’তে হবে
আল্লাহর পথে পরকালীন স্বার্থে এবং আল্লাহ প্রেরিত হক-এর দিকে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلاً مِّمَّنْ دَعَا إِلَى اللهِ وَعَمِلَ صالِحاً ঐ ব্যক্তির চাইতে উত্তম কথা কার আছে, যে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান করে এবং সৎকর্ম
সম্পাদন করে… (হা-মীম সাজদাহ
৪১/৩৩)। আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, وَادْعُ إِلَى رَبِّكَ وَلاَ تَكُونَنَّ مِنَ الْمُشْرِكِينَ ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের দিকে মানুষকে আহবান
কর এবং অবশ্যই তুমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত
হয়ো না’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৭)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, الدِّينُ النَّصِيحَةُ ‘দ্বীন হ’ল নছীহত’। প্রত্যেক মুমিন পরস্পরকে হক-এর উপদেশ দিবে।
যেমন কাউকে শিরক কিংবা বিদ‘আত করতে দেখলে বা কোন ফরয কাজে গাফলতি
দেখলে তাকে বলবে, হে ভাই! শিরক বর্জন কর। ফরয কাজটি আগে
সম্পন্ন কর। অনুরূপভাবে কাউকে কোন অন্যায় করতে দেখলে বলবে, হে ভাই! আল্লাহকে ভয় কর! অন্যায় থেকে বিরত হও।
রাসূল (ছাঃ) বিদায় হজ্জের ভাষণে
মানবজাতির কাছে দু’টি আমানত রেখে গেছেন। তিনি বলেন, تَرَكْتُ
فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوْا مَا مَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ
وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ– ‘আমি তোমাদের মাঝে দু’টি বস্ত্ত ছেড়ে যাচ্ছি। যতদিন
তোমরা এ দু’টি বস্ত্তকে শক্তভাবে অাঁকড়ে থাকবে, ততদিন পথভ্রষ্ট হবে না। আল্লাহর
কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ’।
অতএব ‘হক’-এর ব্যাখ্যা রাসূল (ছাঃ) নিজেই
দিয়ে গেছেন এবং নিজের নবুঅতী জীবনে সেই হক-এর প্রচার ও প্রতিষ্ঠা দান করে গেছেন।
যদি বিশ্বকে অন্যায়-অনাচার ও অশান্তির দাবানল থেকে বাঁচাতে হয়, তাহ’লে পরস্পরকে আল্লাহ প্রেরিত ‘হক’ তথা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ
সুন্নাহকে আকড়ে ধরার উপদেশ দিতে হবে, অন্য কিছুকে নয় বা তাতে কোনরূপ
যোগ-বিয়োগ নয়।
দাওয়াতের ফযীলত
: মানুষের নিকট হক-এর এই দাওয়াত দেওয়া ফরয।
রাসূল (ছাঃ) এসেছিলেন ‘আল্লাহর পথের দাঈ’ হিসাবে (আহযাব ৩৩/৪৬)। তিনি বলেন, (১) بَلِّغُوا عَنِّى وَلَوْ آيَةً- ‘একটিমাত্র আয়াত হলেও তা আমার পক্ষ থেকে
মানুষের নিকট পৌঁছে দাও। (২) তিনি আরো বলেন, مَنْ دَلَّ عَلَى خَيْرٍ فَلَهُ
مِثْلُ أَجْرِ فَاعِلِهِ ‘কেউ যদি কোন নেক কাজের পথনির্দেশ দেয়, সে ঐ নেক কাজ সম্পাদনকারীর সমতুল্য ছওয়াব পায়’।
৩। আব্দুল্লাহ
ইবনু আববাস (রাঃ) সপ্তাহে প্রতি শুক্রবার অথবা সপ্তাহে বেশীর বেশী দুই বা তিনদিন
মানুষকে ডেকে মজলিস করে দাওয়াত দিতে বলতেন।অনুরূপভাবে ইবনু মাসঊদ (রাঃ) প্রতি বৃহস্পতিবারে
দাওয়াত দিতেন।
(৪) ছবর (الصبر) : সমাজগত গুণের দ্বিতীয়টি হ’ল, ‘পরস্পরকে
ছবরের উপদেশ দেওয়া’ (وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ)। আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا يُوَفَّى
الصَّابِرُوْنَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ ‘ধৈর্য্যশীল বান্দাদের বেহিসাব পুরস্কার দান
করা হবে’ (যুমার ৩৯/১০)।
ছবর’ তিন প্রকার :
(১) বিপদে ছবর করা (الصبر فى المصيبة) (২) পাপ থেকে ছবর করা অর্থাৎ বিরত থাকা (الصبر عن المعصية) (৩) আল্লাহর আনুগত্যে ছবর করা অর্থাৎ দৃঢ়
থাকা (الصبر على الطاعة)। প্রথমটি ‘আম’ বা সাধারণ। দ্বিতীয়টি ‘হাসান’ বা সুন্দর এবং
তৃতীয়টি ‘আহসান’ বা সবচেয়ে
সুন্দর। যদি নাকি সবগুলি কেবল আল্লাহর ওয়াস্তে হয়। আল্লাহ যেন আমাদেরকে সত্যের পথে
উক্ত তিন প্রকার ছবর এখতিয়ার করার তাওফীক দান করেন- আমীন!
হক-এর অনুসারী হওয়ার অপরাধে বাতিলের পূজারী
আবু জাহলদের অত্যাচারে নিগৃহীত বেলাল, খাববাব, খোবায়েব, আছেম, ইয়াসির পরিবার প্রমুখ সত্যসেবীগণ ছবর ও দৃঢ়তার যে
অতুল্য নমুনা রেখে গেছেন, যুগে যুগে তা সকল হকপন্থীর জন্য আদর্শ হয়ে
থাকবে। ইয়াসির পরিবারের উপরে অমানুষিক নির্যাতনের মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে ব্যথাহত
রাসূল (ছাঃ) সেদিন তাদের সান্ত্বনা দিয়ে ছোট্ট একটি বাক্য উচ্চারণ করে বলেছিলেন, صَبْرًا يَا آلَ يَاسِرْ فَإِنَّ مَوْعِدَكُمُ الْجَنَّةُ ‘ছবর কর হে ইয়াসির পরিবার! তোমাদের ঠিকানা হ’ল জান্নাত’। তপ্ত মরুর বুকে নির্যাতিত ইয়াসির পরিবারের ব্যথিত
হৃদয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর এই সান্ত্বনাবাক্য সেদিন যে শান্তির সুবাতাস বইয়ে দিয়েছিল, আজও তা হ’তে পারে যেকোন
হকপন্থীর জন্য শক্তির আবেহায়াত। তবে এই ছবর সর্বাবস্থায় নয়। বরং শক্তি থাকলে
যালেমের যুলুম প্রতিরোধ করতে হবে এবং এজন্য সাধ্যমত শক্তি অর্জনের নির্দেশ এসেছে
রাসূল (ছাঃ)-এর মাদানী জীবনে (আনফাল ৮/৬০)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, الْمُؤْمِنُ الْقَوِىُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللهِ مِنَ
الْمُؤْمِنِ الضَّعِيْفِ ‘শক্তিশালী মুমিন আল্লাহর নিকট উত্তম ও অধিক
প্রিয় দুর্বল মুমিনের চাইতে’।
ছবরের ফযীলত :
১) আল্লাহ বলেন, وَجَزَاهُمْ
بِمَا صَبَرُوا جَنَّةً وَحَرِيْرًا- مُتَّكِئِيْنَ فِيْهَا عَلَى الْأَرَائِكِ
لاَ يَرَوْنَ فِيْهَا شَمْسًا وَلاَ زَمْهَرِيْرًا ‘আর তাদের ছবরের পুরস্কার স্বরূপ তিনি তাদেরকে জান্নাত ও
রেশমী পোষাক দান করবেন’। ‘তারা সেখানে সুসজ্জিত আসনে হেলান দিয়ে বসবে। সেখানে তারা অতিশয় গরম
বা অতিশয় শীত কোনটাই দেখবে না’ (দাহর ৭৬/১২-১৩)।
(২) তিনি বলেন, وَبَشِّرِ
الصَّابِرِيْنَ- الَّذِيْنَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ
وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُوْنَ ‘তুমি ধৈর্য্যশীলদের সুসংবাদ দাও’। ‘যাদের উপর কোন বিপদ আসলে বলে, নিশ্চয়ই আমরা সবাই আল্লাহর জন্য
এবং আমরা সবাই তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী’ (বাক্বারাহ ২/১৫৫-৫৬)।
সর্বোত্তম জাতির বৈশিষ্ট্য :
অত্র
সূরায় বর্ণিত চারটি গুণের মধ্যে শেষোক্ত দু’টি গুণ হ’ল মুসলমানের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
যেটি আল্লাহ অন্যত্র ‘আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি আনিল মুনকার’ বলে অভিহিত করেছেন। যেমন আল্লাহ
বলেন, كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ
تَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُوْنَ
بِاللهِ- ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। যাদের
উদ্ভব ঘটানো হয়েছে এ জন্যে যে, তোমরা মানুষকে ন্যায়ের আদেশ দিবে ও অন্যায়ের নিষেধ করবে এবং
আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখবে’ (আলে ইমরান ৩/১১০)।
মূলতঃ এ কাজটিই হ’ল সর্বোত্তম জাতি হওয়ার
মাপকাঠি। সৎকাজের আদেশ বা উপদেশ দেওয়া তুলনামূলকভাবে কিছুটা সহজ হ’লেও অসৎকাজে নিষেধ ও বাধা দানের
কাজটা সর্বদা কঠিন। আর সেজন্যেই সেখানে ছবরের কথা এসেছে। মুসলমানকে তার
চিন্তায়-চেতনায়, কথায়-কর্মে, ব্যবহারে-আচরণে সর্বদা সর্বাবস্থায় ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের
নিষেধ-এর মূলনীতি অনুসরণ করে চলতে হবে। তবেই সমাজ পরিশুদ্ধ হবে। দুনিয়া ও আখেরাতে
সফলতা আসবে।
সূরা আসর এর শিক্ষা
১. দুনিয়া ও আখিরাতের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার
জন্য প্রকৃত ঈমানদার হতে হবে।
২.প্রকৃত ঈমানদারকে অবশ্যই সৎ কাজ করতে হবে
এবং পরস্পরকে হক কথা বলতে হবে।
৩. ঈমানদের কে অবশ্যই বাতিলের বিরুদ্ধে কথা
বলতে হবে, এবং বাতিলকে মাথা উচু করে দাড়াতে
দেবেনা।
৪. হকের পথে চলার সময় বাধা বিপত্তি
আসবে তখন অবশ্যই ধৌর্য ধারণ করে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হবে।
দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচার জন্য চারটি গুণ
অর্জন করা অপরিহার্য। ঈমান, আমল, দাওয়াত ও ছবর। যার কোন একটি গুণের কমতি থাকলে কেউ পূর্ণাঙ্গ মুমিন
হ’তে পারবে না এবং ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে পারবে না।
0 মন্তব্যসমূহ